সর্বশেষ সমাচার

ভারত হাসিনা সরকার টিকিয়ে রাখার কে?

মোঃ শহর আলী 20.Aug.2022; 03:12:07

সম্প্রতি বাংলাদেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এর একটি বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও মিডিয়ায় ব্যপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মহল বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে দেখছেন।

বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী- বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় যাতে থাকতে পারে তার জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেন, আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাঁকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্র্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

ভারত সফরের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমি বলেছি, আমার দেশে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমার দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না, আপনার দেশেও যেমন দুষ্ট লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে আপনাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা কিছু কথা বলেছিলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এ ধরনের প্রটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরও সোচ্চার হয়ে আরও বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হবে। আমাদের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হবে।'

মন্ত্রী বলেন, 'ভারতকে বলেছি, আমরা উভয়ে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডকে কখনও প্রশ্রয় দেব না। এটা যদি আমরা করতে পারি, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের মঙ্গল। শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। ২৮ লাখ লোক আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ভারতে বেড়াতে যায়। ভারতের কয়েক লাখ লোক আমাদের দেশে কাজ করে। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের সুন্দর অবস্থানের কারণে। সুতরাং আমরা উভয়ে এমনভাবে কাজ করব যাতে কোনো ধরনের উস্কানিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। ভারত সরকারকে বলেছি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে যদি আমরা উভয়ে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেই।'

বিষয়টিকে অনেক বুদ্ধিজীবি (?!) বড় ইস্যু হিসেবে দেখছেন এবং পানি ঘোলা করার যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে একটু বিশ্লেষণ দরকার। রাজনৈতিক মহল যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিল তখন আওয়ামীলীগ নেতারা কিন্ত মোমেন সাহেবকে সমর্থন দিয়ে দাড়ালেন না। বরং তাদের কেউ কেউ বললেন, তিনি আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ নন।

এর থেকে দুটি প্রশ্ন সামনে আসে-

এক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি একটা দুধের শিশু যে, সত্যিই যদি তিনি ভারতকে হাসিনা সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করে থাকেন তবে তা মিডিয়ার সামনে ভরা মজলিশে প্রচার করে বেড়াবেন?

দুই, আওয়ামীলীগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সমর্থন দিয়ে তার পক্ষে কিছুই বলেনি। তাহলে কি  এটাই সত্যি যে তারা ভারতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আছে?

এক নম্বর প্রশ্রের উত্তরে নির্দিধায় এটা বলা যায় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো হেভিওয়েট কোন নেতা দলের কোন গোপন বিষয় এভাবে প্রচার করতে পারেন না। এর মানে হলো, তিনি ভারতকে হাসিনা সরকার টিকিয়ে  রাখার জন্য এমন কিছু বলেন নি। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী একজন মানুষ  হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কিছু বলেছেন। এটা হতে পারে যে তিনি হয়তো ভারতের নেতাদের সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা করেছেন যে, ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হলে তা বাংলাদেশে ব্যপক প্রভাব পড়ে যা শেখ হাসিনা সরকারের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাড়ায়।  এর প্রমাণ হিসেবে বলা যায় যখন নরেন্দ্র মোদি সর্বশেষ এদেশে আসেন, খুলনা যান তখন সারাদেশে মৌলবাদীরা ব্যপক আন্দোলন করেছিল। আন্দোলন থামাতে হাসিনা সরকারকে বেগ পেতে হয়েছিল। আর এরুপ মৌলবাদীদের প্রতিটা আন্দোলন থামাতে গিয়ে একটা বার্তা দেশের মানুষের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় যে, হাসিনা সরকার ইসলাম বিরোধী এবং অথবা ভারতের পক্ষের শক্তি।

দুই নম্বর প্রশ্রের উত্তরে অনেক কিছুই বলা যায়। 1971 সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যেভাবে এদেশকে সাহায্য করেছিল তা সবাই জানে। অন্যদিকে বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারত নিরাপদ বোধ করে। যার ফলে ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন আওয়ামীলীগের প্রতি তাদের সহানুভূতি বেশি থাকে। এ থেকে অনেকের ধারণা হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য ভারত সবকিছু করতে পারে।

এখন কথা হলো বাজারে কিছুটা হলেও যে কথাটি প্রচলিত আছে আওয়ামীলীগ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে তার সাথে হুবুহু মিলে যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর  বক্তব্য। ফলে মোমেন সাহেবকে সমর্থন দিয়ে আওয়ামীলীগ আর বিপদে পড়তে চায় না বলেই মনে হচ্ছে।

তবে কথা হুবুহু মিলে গেলেও সব কথার অর্থ এক হয় না।  যেমন একটা গল্প বলি।

একবার সন্ত্রাসী ধরার জন্য পুলিশ একটা জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে একটা পুরোনো একটা ঘরের পিছনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ঘরের ভিতর থেকে কথা ভেসে আসছিল “মাঠের পাশে যে বটগাছটা আছে তার পাশে আছে এই খেলার মাঠ। এই মাঠে ছেলেরা খেলাধুলা করে। তোমাদেরকে এই মাঠেই বোমা টা মারতে হবে, বুঝেছ?” উত্তরে কয়েকজন বলল, “জি ওস্তাদ বুঝেছি।”

পুলিশ ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে গিয়ে দেখল একজন আর্ট শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে খেলার মাঠে বোমা মারার দৃশ্য অঙ্কন করা শেখাচ্ছেন।

কাজেই আমার যা মনে হচ্ছে তা হলো মোমেন  সাহেব যা বলতে চেয়েছেন তার অর্থ উল্টে গেছে। আমার এটাও মনে হচ্ছে যে, এদেশের নেতারাও বিষয়টি ভাল করেই বুঝেছেন কিন্তু নিজেদের সুবিধামতো অর্থ করে নিয়েছেন।

 এ বিষয়ে ব্যাখ্যার জন্য একটু পিছনের দিকে ঘুরে আসা দরকার।

1947 সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে। অনেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের। পাকিস্তানী শাসকদের দু:শাসনের কারনে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে 1971 সালে। পাকিস্তান আমলে এদেশের প্রায় 30% মানুষ মুসলিমলীগের সমর্থক ছিলেন। অধিকাংশ মাদ্রাসা এবং মুসলিমলীগের সমর্থকেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন। কাজেই তারা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন।

এই নেতিবাচকতা পৈত্রিক র্সূত্রে পেয়েছেন শেখ হাসিনাও। তাই এদেশে রাজনীতি করা তার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। শেখ হাসিনার উপর বহুবার হামলা হয়েছে তাঁকে হত্যার জন্য। এখনো এদেশে এই  স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তিবর্গ ও তাদের প্রজন্ম জীবন্ত ও সক্রিয়।

তাছাড়া 92% মুসলামানের দেশ বাংলাদেশে ধর্ম খুবই স্পর্শকাতর হওয়া স্বাভাবিক। এখানে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সামান্য কিছু ঘটলেই আগ্নেয়গিরির বিষ্ফোরণ ঘটে। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য বসে আছে কিছু বিরোধী দল। 2013-14 সালের হেফাজতের আন্দোলনের সময় তারই কিছু নমুনা দেখা গিয়েছিল। বিরোধীদল গুলোর নিজের বাহুতে শক্তি না থাকলেও মানুষের আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে তারা পটু।

এদিকে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তলানিতে ঠেকেছে বলা যায়। সেখানে মসজিদ ভাঙচুর, মুসলিম নিধন, বাড়িঘর জ্বালানো স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। তারই উত্তাপ এসে পড়ে আমাদের আগ্রেয়গিরিতে। ফলে আগ্নেয়গিরি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আগ্নেয়গিরি জ্বলে ওঠে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ বজায় রাখতে শেখ হাসিনার বিকল্প নাই। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য তা মঙ্গল। তাই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা দরকার।

তাছাড়া ভারতের স্বার্থেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। 1998 সালে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী অনুপ চেটিয়াকে গ্রেফতার করেছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা থাকলে বোড়োল্যান্ড, নাগাল্যান্ড সহ উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার্স নিরাপদে থাকবে এ কথা ভালই জানে ভারত সকার এবং সে দেশের মানুষ।

এমতাবস্থায় শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতকে যা যা করার ব্যাপারে মোমেন সাহেব ইঙ্গিত করেছেন তা হয়তো এরকম-

  1. ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার না করা।
  2. মুসলিম বিরোধী বক্তব্য দেয়া বন্ধ করা।
  3. ভারতে মুসলিমদের নিরাপত্তা দেওয়া।
  4. মুসলিমদের গোমাংশ খাওয়ার ব্যাপারে বাধা না দেয়া।
  5. মুসলিমদের বাড়িঘর জ্বালানো বন্ধ করা।
  6. মসজিদ ভাঙ্গা ও পোড়ানো বন্ধ করা।
  7. মসজিদে মাইকে আজান দেওয়া বন্ধ করা থেকে বিরত থাকা।
  8. মেয়েদের হিজাব পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ না করা ।
  9. মুসলিমদের ভোটাধিকার বন্ধের ষঢ়যন্ত্র বন্ধ করা।
  10. চাকরি-ব্যবসা সর্বত্র ‍মুসলিমদের সমান অধিকার দেওয়া।

ভারতকে কি করতে হবে তা বাংলাদেশ শিখিয়ে দিতে পারে না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রক্ষার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারত চাইলে উপরোক্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে পারে। তবে এটা তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাইলেই ভারত তাদের আচরণ থেকে পিছু হটবে বলে আশা করা নিরর্থক।

 

 

আরো %E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7